এক প্রবাসী ভাইয়ের গল্পের কাহিনী
আমি প্রবাসে থাকি প্রায় ছয় বছর হলো।
একটা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ আমি। বাবা নেই, মাকে নিয়েই আমার সব দুনিয়া।
মায়ের জন্যই এত কষ্ট সহ্য করি— যেন তিনি অন্তত একদিন নিশ্চিন্তে বাঁচতে পারেন।
কিন্তু কয়েক সপ্তাহ আগে ফোন এলো,
“তোমার মা হাসপাতালে ভর্তি, দ্রুত অপারেশন করতে হবে।”
খরচ লাগবে প্রায় ১০ লাখ টাকা।
আমি প্রবাসে থাকা অবস্থায় তত টাকা একসাথে জোগাড় করতে পারিনি।
কিছু বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম।
ঠিক তখনই চাচার ফোন এলো—
তিনি বললেন,
“তুই দেশে আয়, একটা উপায় আছে।”
দেশে ফিরেই জানলাম, চাচা টাকা দিতে পারবেন,
তবে একটা শর্ত আছে—
আমাকে তাঁর মেয়েকে, মানে আমার চাচাতো বোন নীলাকে বিয়ে করতে হবে।
আমি অবাক!
বললাম, “চাচা, এটা কেমন কথা?”
চাচা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“ওর জীবনে যা ঘটেছে, তোর জানার দরকার নেই। শুধু এটুকু বলছি, ও এখন একা… সবাই দূরে সরে গেছে। তুই যদি না বিয়ে করিস, আমি ওকে আর বাঁচিয়ে রাখতে পারব না।”
আমি চুপ করে রইলাম।
হাসপাতাল থেকে ফোন এলো—
মায়ের অবস্থা সংকটজনক।
তখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় পেলাম না।
আমি শুধু বলেছিলাম,
“ঠিক আছে চাচা… আমি রাজি।”
বিয়েটা খুব ছোট করে হলো।
কোনো গান-বাজনা নেই, হাসিরও তেমন শব্দ নেই।
নীলা মাথা নিচু করে বসে ছিল সারাক্ষণ।
সেদিন রাতে আমি রুমে ঢুকলাম অনেক দেরি করে।
নীলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল।
চাঁদের আলোয় ওর মুখটা অদ্ভুত শান্ত লাগছিল— যেন ঝড়ের পরের নীরবতা।
আমি বললাম,
“নীলা, এখন বিশ্রাম নাও।”
ও ধীরে বলল,
“তুমি জানো, আমার বিয়ে এইভাবে হচ্ছে কেন?”
আমি মাথা নাড়লাম,
“না… জানি না। জানতেও চাই না এখন।”
ও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর মৃদু গলায় বলল,
“তোমার মতো একজন মানুষ হয়তো ঘৃণা করবে আমায়।”
আমি বললাম,
“মানুষ কখনো ঘৃণার যোগ্য হয় না, পরিস্থিতি হয়।”
ও আমার দিকে একবার তাকিয়ে নীরবে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
আমি সোফায় বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলাম।
জীবনে অনেক কিছু ভেবেছি, কিন্তু এমন এক নীরব রাত কল্পনাও করিনি।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল আজানের শব্দে।
আমি দেখি, নীলা তখনও ঘুমাচ্ছে।
চুল এলোমেলো, মুখে একধরনের নিষ্পাপ শান্তি।
অজান্তেই আমি তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
তারপর নিজেই লজ্জা পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
চাচা ফোন করে জানালেন—
“তোর মায়ের অপারেশন শেষ, এখন অনেকটা ভালো আছে।”
শুনে মনে হলো বুকের ভেতর জমে থাকা পাহাড়ভরা ভার এক মুহূর্তে নেমে গেল।
চোখের ভেতর গরম পানি ঘুরপাক খাচ্ছিল, তবুও বাইরে আসতে দিলাম না।
শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলাম—
আকাশটা আজ কেমন শান্ত, যেন আল্লাহও একটু দম ফেলেছেন।
চাচা বললেন,
“আজই নীলাকে নিয়ে হাসপাতালে যাস।”
আমি গাড়ি স্টার্ট দিলাম, নীলা জানালার পাশে চুপ করে বসে রইল।
রাস্তায় কারো মুখে কথা নেই।
শুধু গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ আর মাঝেমধ্যে হালকা বাতাসের সুর।
নীলার চোখ আধভেজা, মনে হয় সারারাত ঘুমায়নি।
ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো—
ওরও নিজের ভেতর একটা যুদ্ধ চলছে, যেটার কোনো শব্দ নেই,
শুধু নীরবতা।
হাসপাতালে পৌঁছে দেখি মা বিছানায় শুয়ে আছেন, কিন্তু মুখে একটুখানি হাসি।
ওই হাসিটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শান্তি।
আমি মায়ের হাত ধরলাম।
মা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললেন,
“তুই কষ্ট পেয়েছিস না বাবা?”
আমি ঠোঁটে হাসি আনতে চেষ্টা করলাম,
“না মা, তুমি ভালো আছো এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।”
নীলা তখন মায়ের পাশে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
কিছু না বলেও যেন অনেক কিছু বলে ফেলল।
তারপর হঠাৎই মায়ের হাত ধরে কেঁদে ফেলল—
নীরব, দম বন্ধ করা কান্না।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।
মা নীলার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“বাবা, কেঁদে মনটা হালকা করো…
তোমাদের দুজনেরই জীবন অনেক লড়াই দেখেছে।
এখন সময় একে অপরকে একটু শান্তি দেওয়ার।”
ওই মুহূর্তে আমার বুকের ভেতর কেমন একটা ভার জমে গেল।
কীভাবে যেন মনে হচ্ছিল—
এই মেয়েটা আমার জীবনে আসার কথা ছিল ঠিক এমনভাবেই,
একটা ভুল পৃথিবী থেকে একটু আলো ধার করে আনতে।
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আমরা গাড়িতে উঠলাম।
চুপচাপ, কেউ কিছু বলছিলাম না।
আসার পথে নিলা হঠাৎ বলে উঠলো “আজ অনেকদিন পর ভালো লাগছে।”
আমি তাকালাম,
“কেন?”
ও বলল,
“কারণ আজ মনে হয়েছে, আমি এখনো ‘অন্য কেউ’ হয়ে যাইনি। এখনো আমি শুধু নীলা।”
আমি কিছু বললাম না।
শুধু গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবছিলাম—
কিছু মানুষকে আমরা বিয়ে করি না প্রেম থেকে,
করি দায়িত্ববোধ থেকে।
কিন্তু সেই দায়িত্বই কখনো কখনো
সবচেয়ে নিখুঁত ভালোবাসায় পরিণত হয়— জানিনা উপরওয়ালা আমাদের ভাগ্যে কি লিখে রেখেছেন?

বাংলা লিপির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url